মরিচ কী জিনিস, ইউরোপীয়রা তা জেনেছে খুব বেশিদিন আগে নয়_ এমন ধারণা বিলকুল ভুল। চূর্ণকৃত গোলমরিচ খাওয়ার অভ্যাস তাদের দীর্ঘদিনের। গ্রিক ও রোমান সভ্যতার যুগে ঝালযুক্ত খাবারের প্রচলন ছিলো। ইউরোপে গোলমরিচ আমদানি হতো এশিয়ার মসলা দ্বীপপুঞ্জ থেকে। আর এই বস্তুটিই সচল রেখেছিলো আলেকজান্দ্রিয়া, জেনোয়া ও ভেনিস বন্দরের অর্থনীতিকে। মধ্যযুগে এসে গোলমরিচ বনে যায় বিলাসী পণ্য। তখন শস্যের বিনিময়ে এটি কিনতে হতো এবং সেজন্য আলাদা ভাড়া আর করও গুনতে হতো। অটোমান সাম্রাজ্যের উত্থানের ফলে এশিয়াতে আসার ভূমি ও নৌপথগুলো বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলো। যে কারণে ভারতে পৌঁছার নতুন পথ খুঁজতে শুরু করলো ইউরোপীয় বণিকরা। উদ্দেশ্য ছিলো_ গোলমরিচ ছাড়াও অন্যান্য আকর্ষণীয় মসলা এবং রেশম ও আফিম সংগ্রহ করা।
ভারতে পেঁৗছার পশ্চিমাভিমুখী রাস্তা খুঁজে পেতে ক্রিস্টোফার কলম্বাস ১৪৯২ সালে যাত্রা শুরু করেছিলেন স্পেন থেকে। ইউরোপের রন্ধনকে নিশ্চিত করাই ছিলো তার লক্ষ্য, রন্ধনের কোনো পরিবর্তন নয়। কিন্তু ঘটনাক্রমে তার এ সফরের মাধ্যমেই ইউরোপের রান্নার প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন সূচিত হয়েছিলো। ইতালিয়ান নাবিক কলম্বাসের ভারত পৌছানোর সৌভাগ্য আর হয়নি। নতুন যে জায়গায় তিনি গেলেন, সেখানে সন্ধান পেলেন এক অভিনব রঙিন বস্তুর (যার বাংলা নামকরণ মরিচ)। কয়েক বছরের মধ্যেই দক্ষিণ ইউরোপের খাবারে মরিচের স্বাদ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিলো। এই মরিচ ভারত, চীন এবং থাইল্যান্ডের রন্ধন প্রণালীতেও বিপস্নব ঘটিয়ে দিতে খুব একটা সময় নেয়নি।
মরিচ শব্দের ইংরেজি হচ্ছে 'চিলি'। উচ্চারণ অভিন্ন হলেও বানানে রয়েছে রকমফের (Chili, Chilli, Chile, Chile Pepper) । কিন্তু বানান ও নামে কী আসে যায়! বৈশ্বিকরণ গল্পের আগ্রহ-সঞ্চারক অধ্যায় হলো মরিচ। এতো দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার ইতিহাস পৃথিবীর অন্য কোন খাবারেরই নেই। কতো অঞ্চলের, কতো লোক যে এখন মরিচ ভক্ষণ করছে, তার কোন সঠিক পরিসংখ্যান নেই। চীন, ভারত কিংবা থাইল্যান্ডের মরিচপ্রেমীকে জিজ্ঞেস করলে উত্তর একটিই আসবে, 'মরিচ আমাদের দেশজ বস্তু, আমাদের মাতৃভূমির অবিচ্ছেদ্য অংশ। পুরোপুরি মিশে আছে আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে। ইউরোপ ও আমেরিকায় মরিচ আসক্তের সংখ্যা কম, কিন্তু তারাও আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে ঝালের ব্যাপারে কথা বলতে গিয়ে।
কয়েকশ কোটি লোকের পেট ভরায় ধান এবং গমের মতো শস্য। এগুলোর সঙ্গে মরিচের কোন তুলনা চলে না, এমনকি আলুর সঙ্গেও নয়। কিন্তু মূল উপকরণে ঝাল যুক্ত করে গরিবী খানাতেও একটু বড়লোকি আমেজ দিতে মরিচের জুড়ি নেই। কোটি কোটি লোকের কাছে মরিচই একমাত্র বিলাসী উপকরণ, যা তারা নিত্যদিন যোগাড় করতে পারে। এশিয়ার বস্তি থেকে শুরু করে পশ্চিম আফ্রিকার গো-চরণ ভূমিতেও বস্তুটির দেখা মেলে। বর্ণিল খোসার ভেতরই যতো রহস্য। রাসায়নিকগুলো ঝাল উৎপাদন করার মাধ্যমে নিজের প্রতি মানুষকে আসক্ত করে ফেলে। বিখ্যাত ভারতীয় কুক মধুর জেফরি মনে করেন, একবার ঝাল খাবারের স্বাদ নিলে আর পেছনে তাকানোর উপায় নেই। আস্তে আস্তে অভ্যাসে পরিণত হবে। ঝাল না খেলে তখন আর ভালোই লাগবে না।
উৎস দক্ষিণ আমেরিকায়, অধিকাংশ মরিচ বিশেষজ্ঞই এ ব্যাপারে একমত। চিলি নামের দেশটিই তো তার বড় প্রমাণ। ছয় হাজার বছর আগেও দক্ষিণ আমেরিকায় মরিচ উৎপাদিত হতো এবং এর বেচাকেনা চলতো। ওয়াশিংটনের ন্যাশনাল মিউজিয়াম অব ন্যাচারাল হিস্টরির আর্কিওবায়োলজি বিভাগের পোস্ট ডক্টরাল ফেলো লিনডা পেরি ক্যারিবীয় অঞ্চলসহ ভেনিজুয়েলার মরিচের মাইক্রোফসিল চিহ্নিত করেছেন। এই ভদ্রমহিলার দেয়া তথ্যানুসারে, ৬ হাজার ২শ' ৫০ বছর আগে ইকুয়েডরের দক্ষিণাঞ্চলে মরিচের আবাদ হতো। তখন পর্যন্ত ইকুয়েডরের দক্ষিণাঞ্চলে জংলি মরিচের দেখা মেলেনি। পেরু কিংবা বলিভিয়া থেকে মরিচ গিয়েছিলো এই দেশটিতে। পুরো দক্ষিণ আমেরিকা জয় করার পর সেন্ট্রাল আমেরিকাতে পৌছুতেও খুব বেশি সময় লাগেনি এটির। লিনডা পেরি গবেষণায় পেয়েছেন যে, মরিচ সবার আগে ব্যবহার করেছিলো ব্রাজিল।
মরিচ ক্যাপসিকাম বর্গে অন্তভর্ুক্ত এবং নাইটশেড পরিবারের সদস্য। একই পরিবারে রয়েছে টম্যাটো, আলু ও বেগুন গাছ। ক্যাপসিকামের ২৫টি প্রজাতির মধ্যে মাত্র পাঁচটির আবাদ হয়। দক্ষিণ আমেরিকায় অধিকাংশ বনমরিচের দেখা মেলে এখনও। ক্লাসিক বাঁকা লাল অথবা সবুজ মরিচের ব্যবহার হয় মেক্সিকোর রান্নায়। থাইল্যান্ডের লোকজন যেটি ব্যবহার করে সেটি দেখতে বুলেটের মতো, কিন্তু নাম 'বার্ডস আই'। কোনো কোনোটি দেখতে মটর কিংবা হূৎপিন্ডের মতো রং পাল্টে হয়ে যায় একেক স্তরে একেক রকম। তবে মরিচের সাধারণ রঙগুলো হলো_ বিবর্ণ লাল, হলুদ, কালো, উজ্জ্বল কমলা এবং লেবু সবুজ। নিউ মেক্সিকো ইউনিভার্সিটির চিলি পিপার ইনস্টিটিউটের পল বসল্যান্ডের মন্তব্য, হাজারো রকমের মরিচ আছে। নিত্য-নতুন ধরন আবিষ্কৃত হচ্ছে প্রায়ই। মিষ্টি সবুজ ও হলুদ মরিচ এবং ক্যাপসিকামের ব্যবহার হয় সালাদে। অনেকে বেছে নেয় সরাসরি তরকারি হিসেবে।
পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষ দিকে কলম্বাস পৌঁছুলেন ক্যারিবীয় অঞ্চলে। আমেরিকা জুড়ে তখন মরিচের ব্যাপক প্রচলন। আবিষ্কৃত জগৎ থেকে ফিরে আসার সময় ভয়ংকর স্বাদযুক্ত নতুন মসলাটি নিতে ভুললেন না কলম্বাস। নিজেরা এর প্রেমে পড়েননি খুব দ্রুত, কিন্তু বংশবিস্তার করান সোৎসাহে। পতর্ুগীজ বণিকরা এটি ছড়িয়ে দিয়েছিলেন পশ্চিম আফ্রিকা, ভারত এবং পূর্ব এশিয়ায়। কলম্বাসের আমেরিকা পৌঁছানোর ৩০ বছরের মধ্যেরই ভারতের পশ্চিম উপকূলে পর্তুগীজ উপনিবেশ গোয়ায় তিন ধরনের মরিচ চাষ করা হয়েছিলো। থাইল্যান্ডে কিছুদিনের উপস্থিতিতে পর্তুগীজরা স্থানীয়দের খ্রিস্টান বানাতে সমর্থ না হলেও রান্নাঘরে ঠিকই বিপস্নব ঘটিয়ে দিয়েছিলো। ইউরোপীয় ব্যবসায়ীরা মরিচ নিয়ে গিয়েছিলেন জাপান, ইন্দোনেশিয়া, তিব্বত ও চীনে। ৫০ বছরের মধ্যে মরিচ ছড়িয়ে পড়ে পুরো ইউরোপে। ঝাল মরিচ আসার কারণে ভারতে গোলমরিচের ব্যবহার এক পর্যায়ে প্রায় উঠেই গিয়েছিলো।
মাঝে মরিচের ব্যবহার প্রায় ভুলতেই বসেছিলো ইউরোপ। সাম্প্রতিক সময়ে অভ্যাসটা আবার ফিরে এসেছে ইন্ডিয়ান ও থাই রেস্টুরেন্টগুলোর কল্যাণে। ব্রিটিশদের কাছে ভারতীয় খাবার এখন খুবই পছন্দের। সময় ও সুযোগ পেলেই তারা ভারতীয়দের দোকানে ঢু মারে। ২০০১ সালে ব্রিটেনের বিদেশমন্ত্রী রবিন কুক তার পছন্দের খাবারের নাম বলতে গিয়ে চিকেন টিক্কা মাসালার উলেস্নখ করেছিলেন। এ খাবারটি এখন ব্রিটিশ নারীরাও তৈরি করতে পারেন। চিকেন, ক্রিম ও টমেটোর সঙ্গে মরিচসহ অন্যান্য মসলা মিশ্রণ করতে হয়। যুক্তরাষ্ট্রে কয়েক হাজার বছর আগে মরিচের প্রচলন শুরু হলেও এখন তারা নিজেদের তৈরি খাবারে খুব একটা ঝাল দেয় না। তবে ভোজনরসিকদের সপ্তায় অন্তত একদিন মেক্সিকান খাবার চাই-ই চাই। মেক্সিকান খাবারে যে ঝাল থাকে সে কথা সবাই জানে।
ঝাল পরিমাপেরও ব্যবস্থা আছে। আমেরিকান কেমিস্ট উইলবার ১৯১২ সালে ঝাল মাপার স্কেল আবিষ্কার করেন। তার নামানুসারেই নামকরণ হয়েছে স্কভিল হিট ইউনিটস (এস এইচ ইউ)। পৃথিবীর অনেক মরিচের এসএইচইউ হচ্ছে শূন্য। ইতালিয়ানরা পাস্তা তৈরিতে ৫০০ এস এইচ ইউ-এর পিপারোনসিনো নামক মরিচ ব্যবহার করে। থাইল্যান্ডের রান্নায় ব্যবহার করা মরিচের গড় এসএইচ ইউ এক লাখ। দুই লাখের বেশি হলে যে চোখ দিয়েই জল ঝরবে। ঝালের রেকর্ডটি দীর্ঘদিন ধরে রেখেছিলেন ক্যালিফোর্নিয়ার এক বাণিজ্যিক মরিচ ব্যবসায়ী। তার ক্ষেতে উৎপাদিত হচ্ছিলো ৫ লাখ ৭৭ হাজার এসএইচইউ'র মরিচ। উৎপাদিত বস্তুর নাম দিয়েছিলেন তিনি 'রেড সাবিনা'।
আগের সব রেকর্ড মস্নান করে দিয়েছে ভারতের 'ভূত জলোকিয়া'। যার বাংলা অর্থ ভূত মরিচ। এর দেখা মেলে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে। সেনা শহর তেজপুরের ডিফেন্স রিসার্চ ল্যাবরেটরি ২০০০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ঝালের শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করে বসে। প্রথমে তাদের কথা কেউ কানেই তুলছিলো না। ২০০৫ সালে ঝালের তীব্রতা পরীক্ষা করতে রাজি হয় নিউ মেক্সিকো চিলি ইনস্টিটিউট। ফলাফল আসে অবিশ্বাস্য, ৮ লাখ ৫৫ হাজার এসএইচইউ। এখানেই শেষ নয়, নাগাল্যান্ডের আদিবাসীরা 'নাগা চিলি' নামের এক প্রকার মরিচ খায়, যার এসএইচইউ ১০ লাখেরও (আনুমানিক) বেশি। আদিবাসীরা শখে খায় না এটি, তরকারি রান্না করে নিয়মিতভাবে। তবে নাগা চিলির ঝালের তীব্রতা এখনো পরীক্ষিত হয়নি। খুব শিগগিরই এটিকে পাঠানো হবে নিউ মেক্সিকো চিলি ইনস্টিটিউটে।
তেজপুরের ডিফেন্স রিসার্চ ল্যাবরেটরির পরিচালক আরবী শ্রীবাস্তবা টাইম ম্যাগাজিনকে জানিয়েছেন, ভূত জলোকিয়া (ঠযঁঃ লড়ষড়শরধ) ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে খুবই জনপ্রিয়। মরিচের রাজা বলা হয় এটাকে। বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে এই মরিচকে ঘিরে উৎসবও হয়। অদ্ভুত কথা বলেছেন তিনি-টিয়ার গ্যাসে ভূত জলোকিয়া ব্যবহার করা যেতে পারে। দাঙ্গার সময় একটি ছেড়ে দিলে এক কিলোমিটার অঞ্চলে আর কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। যুদ্ধক্ষেত্রে যাওয়ার আগে সৈন্যদের একটি খাইয়ে দিলে দ্বিগুণ তেজে যুদ্ধ করবে। তবে সতর্ক সংকেত শুনিয়েছেন, 'অনভ্যস্ত কাউকে খাওয়ালে টয়লেট হয়ে যাবে তার স্থায়ী ঠিকানা। পাঁচ সেন্টিমিটার লম্বা ভূত জলোকিয়ার রঙ পোড়াটে হলুদ। স্বাভাবিক মরিচের তুলনায় এটি ব্যবহার করতে হয় এক-দশমাংশ। আনাড়ি যে কেউ একটি চিবিয়ে খেলে সারাদিনের জন্য তার জিহবাটাকে অচেতন মনে হতে পারে।
ক্রিস্টোফার কলম্বাস আমেরিকা থেকে আলু ও ট্যামেটোসহ অনেক শাক-সবজি নিয়ে গিয়েছিলেন স্পেনে, কিন্তু কোন কিছুই মরিচের মতো এতো দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারেনি। পাঁচশত বছর পর মরিচ আজ সারা বিশ্বে রাজত্ব করছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে; ঝালের প্রতি আমাদের এতো মোহ কেন? যে জিনিস খেলে আমরা আহত হই, সেই জিনিস আমরা খাই কেনো? প্রশ্ন দুটির সুনিশ্চিত উত্তর কারওই জানা নেই।
মরিচের গুঁড়াতে ক্যাপসাইসিন নামে একটি উপাদান পাওয়া যায় যার সঙ্গে মানুষের ত্বকের ক্যান্সারের যোগসূত্র রয়েছে। নতুন এক সমীক্ষা থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে। ক্যান্সার রিসার্চ নামে একটি সাময়িকীতে এ সমীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করা হয়। মরিচের গুঁড়াতে এ রাসায়নিক উপাদান ব্যাপক পরিমাণে থাকে ও খাদ্যের মাধ্যমে তা ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। এ ছাড়া, বেদনানাশক মলম তৈরির জন্যও এই একই উপাদান ব্যবহার হয়। তবে, ক্যান্সারের বিকাশের ক্ষেত্রে এ রাসায়নিক উপাদানের ভূমিকা নিয়ে বির্তক রয়েছে। ক্যাপসাইসিন ব্যবহারে ক্যান্সার কোষের মৃত্যু হয়।
এ দিকে, নতুন গবেষণায় দেখা গেছে- এই একই রাসায়নিক কারসিনোজেন বা ক্যান্সার সৃষ্টিকারক হিসেবেও কাজ করতে পারে। বিশেষ করে টিউমার হওয়ার প্রথম দিকে তা ক্যান্সার সৃষ্টিকারক হিসেবে কাজ করতে পারে। এই জরিপের নেতৃত্বদানকারী যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যান বোড বলেছেন, সমীক্ষার ভিত্তিতে মনে হচ্ছে ক্যাপসাইসিন প্রদাহ সৃষ্টি করতে পারে এবং ক্যান্সার তৈরির ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে। তিনি বলেন, সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো- ঝাল মরিচের এ প্রাকৃতিক উপাদান বেদনানাশক ওষুধ তৈরিতে ব্যবহার হয় এবং চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়াই এ সব ওষুধ বিক্রি হয়। অথচ এই একই উপাদান ক্যান্সারও তৈরি করতে পারে।
০০ টাইম ম্যাগাজিন অনুসরণে
ভারতে পেঁৗছার পশ্চিমাভিমুখী রাস্তা খুঁজে পেতে ক্রিস্টোফার কলম্বাস ১৪৯২ সালে যাত্রা শুরু করেছিলেন স্পেন থেকে। ইউরোপের রন্ধনকে নিশ্চিত করাই ছিলো তার লক্ষ্য, রন্ধনের কোনো পরিবর্তন নয়। কিন্তু ঘটনাক্রমে তার এ সফরের মাধ্যমেই ইউরোপের রান্নার প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন সূচিত হয়েছিলো। ইতালিয়ান নাবিক কলম্বাসের ভারত পৌছানোর সৌভাগ্য আর হয়নি। নতুন যে জায়গায় তিনি গেলেন, সেখানে সন্ধান পেলেন এক অভিনব রঙিন বস্তুর (যার বাংলা নামকরণ মরিচ)। কয়েক বছরের মধ্যেই দক্ষিণ ইউরোপের খাবারে মরিচের স্বাদ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিলো। এই মরিচ ভারত, চীন এবং থাইল্যান্ডের রন্ধন প্রণালীতেও বিপস্নব ঘটিয়ে দিতে খুব একটা সময় নেয়নি।
মরিচ শব্দের ইংরেজি হচ্ছে 'চিলি'। উচ্চারণ অভিন্ন হলেও বানানে রয়েছে রকমফের (Chili, Chilli, Chile, Chile Pepper) । কিন্তু বানান ও নামে কী আসে যায়! বৈশ্বিকরণ গল্পের আগ্রহ-সঞ্চারক অধ্যায় হলো মরিচ। এতো দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার ইতিহাস পৃথিবীর অন্য কোন খাবারেরই নেই। কতো অঞ্চলের, কতো লোক যে এখন মরিচ ভক্ষণ করছে, তার কোন সঠিক পরিসংখ্যান নেই। চীন, ভারত কিংবা থাইল্যান্ডের মরিচপ্রেমীকে জিজ্ঞেস করলে উত্তর একটিই আসবে, 'মরিচ আমাদের দেশজ বস্তু, আমাদের মাতৃভূমির অবিচ্ছেদ্য অংশ। পুরোপুরি মিশে আছে আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে। ইউরোপ ও আমেরিকায় মরিচ আসক্তের সংখ্যা কম, কিন্তু তারাও আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে ঝালের ব্যাপারে কথা বলতে গিয়ে।
কয়েকশ কোটি লোকের পেট ভরায় ধান এবং গমের মতো শস্য। এগুলোর সঙ্গে মরিচের কোন তুলনা চলে না, এমনকি আলুর সঙ্গেও নয়। কিন্তু মূল উপকরণে ঝাল যুক্ত করে গরিবী খানাতেও একটু বড়লোকি আমেজ দিতে মরিচের জুড়ি নেই। কোটি কোটি লোকের কাছে মরিচই একমাত্র বিলাসী উপকরণ, যা তারা নিত্যদিন যোগাড় করতে পারে। এশিয়ার বস্তি থেকে শুরু করে পশ্চিম আফ্রিকার গো-চরণ ভূমিতেও বস্তুটির দেখা মেলে। বর্ণিল খোসার ভেতরই যতো রহস্য। রাসায়নিকগুলো ঝাল উৎপাদন করার মাধ্যমে নিজের প্রতি মানুষকে আসক্ত করে ফেলে। বিখ্যাত ভারতীয় কুক মধুর জেফরি মনে করেন, একবার ঝাল খাবারের স্বাদ নিলে আর পেছনে তাকানোর উপায় নেই। আস্তে আস্তে অভ্যাসে পরিণত হবে। ঝাল না খেলে তখন আর ভালোই লাগবে না।
উৎস দক্ষিণ আমেরিকায়, অধিকাংশ মরিচ বিশেষজ্ঞই এ ব্যাপারে একমত। চিলি নামের দেশটিই তো তার বড় প্রমাণ। ছয় হাজার বছর আগেও দক্ষিণ আমেরিকায় মরিচ উৎপাদিত হতো এবং এর বেচাকেনা চলতো। ওয়াশিংটনের ন্যাশনাল মিউজিয়াম অব ন্যাচারাল হিস্টরির আর্কিওবায়োলজি বিভাগের পোস্ট ডক্টরাল ফেলো লিনডা পেরি ক্যারিবীয় অঞ্চলসহ ভেনিজুয়েলার মরিচের মাইক্রোফসিল চিহ্নিত করেছেন। এই ভদ্রমহিলার দেয়া তথ্যানুসারে, ৬ হাজার ২শ' ৫০ বছর আগে ইকুয়েডরের দক্ষিণাঞ্চলে মরিচের আবাদ হতো। তখন পর্যন্ত ইকুয়েডরের দক্ষিণাঞ্চলে জংলি মরিচের দেখা মেলেনি। পেরু কিংবা বলিভিয়া থেকে মরিচ গিয়েছিলো এই দেশটিতে। পুরো দক্ষিণ আমেরিকা জয় করার পর সেন্ট্রাল আমেরিকাতে পৌছুতেও খুব বেশি সময় লাগেনি এটির। লিনডা পেরি গবেষণায় পেয়েছেন যে, মরিচ সবার আগে ব্যবহার করেছিলো ব্রাজিল।
মরিচ ক্যাপসিকাম বর্গে অন্তভর্ুক্ত এবং নাইটশেড পরিবারের সদস্য। একই পরিবারে রয়েছে টম্যাটো, আলু ও বেগুন গাছ। ক্যাপসিকামের ২৫টি প্রজাতির মধ্যে মাত্র পাঁচটির আবাদ হয়। দক্ষিণ আমেরিকায় অধিকাংশ বনমরিচের দেখা মেলে এখনও। ক্লাসিক বাঁকা লাল অথবা সবুজ মরিচের ব্যবহার হয় মেক্সিকোর রান্নায়। থাইল্যান্ডের লোকজন যেটি ব্যবহার করে সেটি দেখতে বুলেটের মতো, কিন্তু নাম 'বার্ডস আই'। কোনো কোনোটি দেখতে মটর কিংবা হূৎপিন্ডের মতো রং পাল্টে হয়ে যায় একেক স্তরে একেক রকম। তবে মরিচের সাধারণ রঙগুলো হলো_ বিবর্ণ লাল, হলুদ, কালো, উজ্জ্বল কমলা এবং লেবু সবুজ। নিউ মেক্সিকো ইউনিভার্সিটির চিলি পিপার ইনস্টিটিউটের পল বসল্যান্ডের মন্তব্য, হাজারো রকমের মরিচ আছে। নিত্য-নতুন ধরন আবিষ্কৃত হচ্ছে প্রায়ই। মিষ্টি সবুজ ও হলুদ মরিচ এবং ক্যাপসিকামের ব্যবহার হয় সালাদে। অনেকে বেছে নেয় সরাসরি তরকারি হিসেবে।
পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষ দিকে কলম্বাস পৌঁছুলেন ক্যারিবীয় অঞ্চলে। আমেরিকা জুড়ে তখন মরিচের ব্যাপক প্রচলন। আবিষ্কৃত জগৎ থেকে ফিরে আসার সময় ভয়ংকর স্বাদযুক্ত নতুন মসলাটি নিতে ভুললেন না কলম্বাস। নিজেরা এর প্রেমে পড়েননি খুব দ্রুত, কিন্তু বংশবিস্তার করান সোৎসাহে। পতর্ুগীজ বণিকরা এটি ছড়িয়ে দিয়েছিলেন পশ্চিম আফ্রিকা, ভারত এবং পূর্ব এশিয়ায়। কলম্বাসের আমেরিকা পৌঁছানোর ৩০ বছরের মধ্যেরই ভারতের পশ্চিম উপকূলে পর্তুগীজ উপনিবেশ গোয়ায় তিন ধরনের মরিচ চাষ করা হয়েছিলো। থাইল্যান্ডে কিছুদিনের উপস্থিতিতে পর্তুগীজরা স্থানীয়দের খ্রিস্টান বানাতে সমর্থ না হলেও রান্নাঘরে ঠিকই বিপস্নব ঘটিয়ে দিয়েছিলো। ইউরোপীয় ব্যবসায়ীরা মরিচ নিয়ে গিয়েছিলেন জাপান, ইন্দোনেশিয়া, তিব্বত ও চীনে। ৫০ বছরের মধ্যে মরিচ ছড়িয়ে পড়ে পুরো ইউরোপে। ঝাল মরিচ আসার কারণে ভারতে গোলমরিচের ব্যবহার এক পর্যায়ে প্রায় উঠেই গিয়েছিলো।
মাঝে মরিচের ব্যবহার প্রায় ভুলতেই বসেছিলো ইউরোপ। সাম্প্রতিক সময়ে অভ্যাসটা আবার ফিরে এসেছে ইন্ডিয়ান ও থাই রেস্টুরেন্টগুলোর কল্যাণে। ব্রিটিশদের কাছে ভারতীয় খাবার এখন খুবই পছন্দের। সময় ও সুযোগ পেলেই তারা ভারতীয়দের দোকানে ঢু মারে। ২০০১ সালে ব্রিটেনের বিদেশমন্ত্রী রবিন কুক তার পছন্দের খাবারের নাম বলতে গিয়ে চিকেন টিক্কা মাসালার উলেস্নখ করেছিলেন। এ খাবারটি এখন ব্রিটিশ নারীরাও তৈরি করতে পারেন। চিকেন, ক্রিম ও টমেটোর সঙ্গে মরিচসহ অন্যান্য মসলা মিশ্রণ করতে হয়। যুক্তরাষ্ট্রে কয়েক হাজার বছর আগে মরিচের প্রচলন শুরু হলেও এখন তারা নিজেদের তৈরি খাবারে খুব একটা ঝাল দেয় না। তবে ভোজনরসিকদের সপ্তায় অন্তত একদিন মেক্সিকান খাবার চাই-ই চাই। মেক্সিকান খাবারে যে ঝাল থাকে সে কথা সবাই জানে।
ঝাল পরিমাপেরও ব্যবস্থা আছে। আমেরিকান কেমিস্ট উইলবার ১৯১২ সালে ঝাল মাপার স্কেল আবিষ্কার করেন। তার নামানুসারেই নামকরণ হয়েছে স্কভিল হিট ইউনিটস (এস এইচ ইউ)। পৃথিবীর অনেক মরিচের এসএইচইউ হচ্ছে শূন্য। ইতালিয়ানরা পাস্তা তৈরিতে ৫০০ এস এইচ ইউ-এর পিপারোনসিনো নামক মরিচ ব্যবহার করে। থাইল্যান্ডের রান্নায় ব্যবহার করা মরিচের গড় এসএইচ ইউ এক লাখ। দুই লাখের বেশি হলে যে চোখ দিয়েই জল ঝরবে। ঝালের রেকর্ডটি দীর্ঘদিন ধরে রেখেছিলেন ক্যালিফোর্নিয়ার এক বাণিজ্যিক মরিচ ব্যবসায়ী। তার ক্ষেতে উৎপাদিত হচ্ছিলো ৫ লাখ ৭৭ হাজার এসএইচইউ'র মরিচ। উৎপাদিত বস্তুর নাম দিয়েছিলেন তিনি 'রেড সাবিনা'।
আগের সব রেকর্ড মস্নান করে দিয়েছে ভারতের 'ভূত জলোকিয়া'। যার বাংলা অর্থ ভূত মরিচ। এর দেখা মেলে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে। সেনা শহর তেজপুরের ডিফেন্স রিসার্চ ল্যাবরেটরি ২০০০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ঝালের শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করে বসে। প্রথমে তাদের কথা কেউ কানেই তুলছিলো না। ২০০৫ সালে ঝালের তীব্রতা পরীক্ষা করতে রাজি হয় নিউ মেক্সিকো চিলি ইনস্টিটিউট। ফলাফল আসে অবিশ্বাস্য, ৮ লাখ ৫৫ হাজার এসএইচইউ। এখানেই শেষ নয়, নাগাল্যান্ডের আদিবাসীরা 'নাগা চিলি' নামের এক প্রকার মরিচ খায়, যার এসএইচইউ ১০ লাখেরও (আনুমানিক) বেশি। আদিবাসীরা শখে খায় না এটি, তরকারি রান্না করে নিয়মিতভাবে। তবে নাগা চিলির ঝালের তীব্রতা এখনো পরীক্ষিত হয়নি। খুব শিগগিরই এটিকে পাঠানো হবে নিউ মেক্সিকো চিলি ইনস্টিটিউটে।
তেজপুরের ডিফেন্স রিসার্চ ল্যাবরেটরির পরিচালক আরবী শ্রীবাস্তবা টাইম ম্যাগাজিনকে জানিয়েছেন, ভূত জলোকিয়া (ঠযঁঃ লড়ষড়শরধ) ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে খুবই জনপ্রিয়। মরিচের রাজা বলা হয় এটাকে। বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে এই মরিচকে ঘিরে উৎসবও হয়। অদ্ভুত কথা বলেছেন তিনি-টিয়ার গ্যাসে ভূত জলোকিয়া ব্যবহার করা যেতে পারে। দাঙ্গার সময় একটি ছেড়ে দিলে এক কিলোমিটার অঞ্চলে আর কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। যুদ্ধক্ষেত্রে যাওয়ার আগে সৈন্যদের একটি খাইয়ে দিলে দ্বিগুণ তেজে যুদ্ধ করবে। তবে সতর্ক সংকেত শুনিয়েছেন, 'অনভ্যস্ত কাউকে খাওয়ালে টয়লেট হয়ে যাবে তার স্থায়ী ঠিকানা। পাঁচ সেন্টিমিটার লম্বা ভূত জলোকিয়ার রঙ পোড়াটে হলুদ। স্বাভাবিক মরিচের তুলনায় এটি ব্যবহার করতে হয় এক-দশমাংশ। আনাড়ি যে কেউ একটি চিবিয়ে খেলে সারাদিনের জন্য তার জিহবাটাকে অচেতন মনে হতে পারে।
ক্রিস্টোফার কলম্বাস আমেরিকা থেকে আলু ও ট্যামেটোসহ অনেক শাক-সবজি নিয়ে গিয়েছিলেন স্পেনে, কিন্তু কোন কিছুই মরিচের মতো এতো দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারেনি। পাঁচশত বছর পর মরিচ আজ সারা বিশ্বে রাজত্ব করছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে; ঝালের প্রতি আমাদের এতো মোহ কেন? যে জিনিস খেলে আমরা আহত হই, সেই জিনিস আমরা খাই কেনো? প্রশ্ন দুটির সুনিশ্চিত উত্তর কারওই জানা নেই।
মরিচের গুঁড়াতে ক্যাপসাইসিন নামে একটি উপাদান পাওয়া যায় যার সঙ্গে মানুষের ত্বকের ক্যান্সারের যোগসূত্র রয়েছে। নতুন এক সমীক্ষা থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে। ক্যান্সার রিসার্চ নামে একটি সাময়িকীতে এ সমীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করা হয়। মরিচের গুঁড়াতে এ রাসায়নিক উপাদান ব্যাপক পরিমাণে থাকে ও খাদ্যের মাধ্যমে তা ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। এ ছাড়া, বেদনানাশক মলম তৈরির জন্যও এই একই উপাদান ব্যবহার হয়। তবে, ক্যান্সারের বিকাশের ক্ষেত্রে এ রাসায়নিক উপাদানের ভূমিকা নিয়ে বির্তক রয়েছে। ক্যাপসাইসিন ব্যবহারে ক্যান্সার কোষের মৃত্যু হয়।
এ দিকে, নতুন গবেষণায় দেখা গেছে- এই একই রাসায়নিক কারসিনোজেন বা ক্যান্সার সৃষ্টিকারক হিসেবেও কাজ করতে পারে। বিশেষ করে টিউমার হওয়ার প্রথম দিকে তা ক্যান্সার সৃষ্টিকারক হিসেবে কাজ করতে পারে। এই জরিপের নেতৃত্বদানকারী যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যান বোড বলেছেন, সমীক্ষার ভিত্তিতে মনে হচ্ছে ক্যাপসাইসিন প্রদাহ সৃষ্টি করতে পারে এবং ক্যান্সার তৈরির ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে। তিনি বলেন, সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো- ঝাল মরিচের এ প্রাকৃতিক উপাদান বেদনানাশক ওষুধ তৈরিতে ব্যবহার হয় এবং চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়াই এ সব ওষুধ বিক্রি হয়। অথচ এই একই উপাদান ক্যান্সারও তৈরি করতে পারে।
০০ টাইম ম্যাগাজিন অনুসরণে
মরিচ
Reviewed by রেজওয়ান
on
1:54 AM
Rating:
No comments: