সিংকোনা


আমরা জানি, সিংকোনা গাছের ছাল থেকেই ম্যালেরিয়ার মহৌষধ কুইনান তৈরি হয়। এই সিংকোনা গাছের আছে এক চমকপ্রদ ইতিহাস। দক্ষিণ আমেরিকার পেরু ও বলিভিয়ার আন্দেজ পাহাড়ে সিংকোনা গাছের আদি বাসভূমি। ওখানকার আদিবাসীরা জ্বর নিরাময়ে এই গাছের ছালের নির্যাস ব্যবহার করে আসছে অতি প্রাচীনকাল থেকে। ১৬৩৮ সালের দিকে পেরুর স্প্যানিশ গভর্নরের স্ত্রী কাউনটেস সিংকোনা ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হন। ওখানকার আদিবাসী বৈদ্যদের সিংকোনার ছাল থেকে তৈরি ওষুধ খেয়ে তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেন। ইউরোপে ফেরার সময় এই গাছের কিছু বীজ সঙ্গে নিয়ে আসেন। কাউনটেসের নাম অনুসারে এই গাছের নামকরণ করা হয় Cinchona। কালক্রমে জেজ্উইট পাদ্রিরা জ্বরের এই অমোঘ ঔষধি গাছের প্রজাতি ইউরোপ ও এশিয়ার বিভিন্ন স্থানে সম্প্রসারণ করে থাকেন। ইংরেজদের হাতেও এই গাছের বীজ চলে আসে। তাদের ভারতীয় উপমহাদেশের কলোনিতে এই সিংকোনা গাছের সম্প্রসারণ হয়ে থাকে উনিশ শতকের মধ্য ভাগ থেকেই। বিশেষ করে ভারতের পাহাড়ি অঞ্চল, শ্রীলঙ্কা ও বার্মায়। এই সম্প্রসারণেরও আছে বিস্ময়কর ঘটনাবলি। তত্কালীন ভারতবর্ষের ভাইসরয়ের স্ত্রী লেডি ক্যানিংসের পরামর্শে কলকাতায় রয়েল বোটানিক্যাল গার্ডেনের সুপারিনটেনডেন্ট অ্যান্ডারসন সাহেবকে জাভায় পাঠানো হয় সিংকোনা চাষের নিয়মাবলি জানার জন্য ১৮৫০ সালের দিকে। উদ্দেশ্য, দর্জিলিং এলাকায় এর চাষ সম্প্রসারিত করা। কিন্তু অ্যান্ডারসন সাহেব সেখানে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। তারপর স্যার জর্জ কিংয়ের প্রচেষ্টায় দার্জিলিংয়ের মংপু ও কালিম্পং অঞ্চলে সিংকোনার চাষ সম্প্রসারিত হয়। আর সেই সঙ্গে কুইনাইন টেবলেট তৈরি করার কারখানা স্থাপিত হয় মংপুতে।
সিংকোনার বেশ কয়েকটি প্রজাতি ও তাদের হাইব্রিডের চাষ বর্তমানে দেখা যায় এশিয়ার বেশ কয়েকটা দেশে। কয়েক প্রজাতির ছাল থেকে হলুদ রঙের কুইনার প্রস্তুত হয়। Cinchona officinali Calisaya থেকে মূলত সাদা কুইনান তৈরি হয়। তাদের পরিবারের নাম Rubiaceae। গাছ সাধারণত ২৫-৩০ ফুট উঁচু হয়। গাছের কাণ্ড গোলাকার। ছাল ধূসর বর্ণের। পাতা বিপরীত ও চার-পাঁচ ইঞ্চি লম্বা। বৃন্ত ঈষত্ লালবর্ণ। পুষ্পদণ্ড বহু শাখা-প্রশাখাবিশিষ্ট। পুষ্পদণ্ডের আগায় গুচ্ছ গুচ্ছ ফুল হয়। আকারে ছোট, হালকা গোলাপি। ফল লম্বাকৃতি। বীজ ছোট চেপ্টা। মে মাসে ফুলের আগমন হয়।
সিংকোনা গাছের ছালে আছে অ্যাকালয়েডস কুইনিন ও কুইনিডিনস। কুইনান ম্যালেরিয়া জ্বরে এক অব্যর্থ মহৌষধ। টাইফয়েড ও বক্ষপ্রদাহ রোগের এক প্রতিষেধক। কুইনিডিন হূিপণ্ড রোগের এক উপকারী ওষুধ, বিশেষ করে ‘কার্ডিয়াক অ্যারিদমিয়া’ উপসর্গে।
সিংকোনা সমতলের গাছ নয়। পাহাড়ি অঞ্চলে শীতল আবহাওয়ায় এর শ্রীবৃদ্ধি। কালিম্পংয়ের কাছে মংপু সিংকোনা বাগানের এক বাংলোয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর শেষ জীবনে বেশ কিছুদিন কাটিয়ে ছিলেন। সেখান থেকে লিখলেন:
ওই ঢালু গিরিমালা রুক্ষ ও বন্ধ্যা
দিন গেলে ওরি পরে জপ করে সন্ধ্যা
নিচে রেখা দেখা যায় ওই নদী তিস্তার
নিঠুরের স্বপ্নে ও মধুরের বিস্তার...

সিংকোনা সিংকোনা Reviewed by রেজওয়ান on 12:53 PM Rating: 5

No comments:

Powered by Blogger.