বেল

নিদারুণ গরমের কালে তৃষ্ণা নিবারণে বেলের শরবতের জুড়ি নেই। এ ছাড়া পেটের গোলমাল বা অজীর্ণের সমস্যায় পড়লেও বেলের খোঁজ পড়ে। সেবনেই দ্রুত নিরাময় নিশ্চিত। বাজারে এ সময় ফলটি সহজলভ্যও।
ফলটি আমাদের দেশের নিজস্ব হলেও এর কোনো ‘অনুমোদিত’ জাত নেই। সারা দেশেই জন্মে। তবে চাঁপাইনবাবগঞ্জে স্থানীয়ভাবে পরিচিত ‘দশসেরী’ জাতের বেলটিই দেশের বেলের মধ্যে সেরা। এ ছাড়া রাজশাহী, নাটোর, দিনাজপুর, গাজীপুর, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ ও জামালপুরে বেল ভালো হয়। যত্ন-আত্তির দরকার হয় না, বসতবাড়ির একধারে একটু ঠাঁই পেলেই মাথা তুলে দাঁড়ায় গাছটি।

অল্প বয়সে বেলগাছের গা জুড়ে তীক্ষ্ন মুখ ও লম্বা কাঁটা। সেটি নিরাপত্তার জন্যই। বয়স বাড়লে হয়তো এদেরও কাণ্ডজ্ঞান হয়, তাই কাণ্ডের কাঁটাগুলো আর থাকে না। অল্প সংখ্যায় থাকে শাখায়। আমাদের দেশের নিজস্ব ফলের মধ্যে পুষ্টিমান ও ঔষধিগুণে বেল অনন্য।

ভারতই বেলগাছের আদি জন্মস্থান। এখন থাইল্যান্ড, মিয়ানমার ও পাকিস্তানেও উন্নত জাতের বেল হচ্ছে। বেলগাছ লম্বায় ১০ থেকে ১৬ মিটার হয়। অত্যন্ত কষ্টসহিষ্ণু। সব ধরনের মাটিতেই জন্মে। হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে অত্যন্ত পবিত্র। সংস্কৃতে এর নাম ‘বিল্ব’। এই বিল্বপত্র ব্যতিরেকে পূজা-অর্চনা চলে না। অনেক ক্ষেত্রে ফল এবং কাঠও প্রয়োজন হয়। হয়তো সে কারণে রান্নার কাজে বেলগাছের লাকড়ি ব্যবহার করেন না হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা। আকৃতিগত সাদৃশ্য দেখে ঔপনিবেশিক সাহেবদের কাছে ফলটিকে আপেলের মতোই মনে হয়েছিল। আর এর কঠিন বহিরাবরণকে প্রাধান্য দিয়েই তাঁরা শ্রীফলকে ডেকেছেন ‘Wood Apple’ নামে। আর বৈজ্ঞানিক নাম Aegle marmelos.
তবে এর শক্ত খোল ভেদ করে ভেতরের অমৃততুল্য শাঁসের হদিস সাহেবরা কতটুকু পেয়েছিলেন, বলা মুশকিল।
সাহেবরা যা-ই বলুন না কেন, বেল কিন্তু মোটেই শুষ্কংকাষ্ঠং গোছের ফল নয়। কাঁচায় রং সবুজ, পাকলে হলুদাভ। ভেতরে শাঁসও সোনালি-হলুদ, মোলায়েম। পাকা ফল মিষ্টি, সুরভিময়। শাঁসের ভেতরে আলাদা স্তরে অনেকগুলো বীজ জড়ানো থাকে আঠার সঙ্গে। তবে সহজেই তা আলাদা করা যায়। বেল প্রচুর পরিমাণ শর্করা, ভিটামিন সি, ক্যালসিয়াম, লৌহ, ক্যারোটিনসহ মূল্যবান খনিজে সমৃদ্ধ। কাঁচা ফলও উপকারী। তিব্বিয়া হাবিবিয়া কলেজের সহকারী অধ্যাপক হাকিম ফেরদৌস ওয়াহিদ জানিয়েছেন আমাশয়, কোষ্ঠকাঠিন্য প্রভৃতি আন্ত্রিক রোগ নিরাময়ে বেলশুঁটু কার্যকর। এ ছাড়া পাতার রসের সঙ্গে মধু মিশিয়ে পান করলে চোখের ছানি ও জ্বালাপোড়ার উপশম হয়। এই মিশ্রণের সঙ্গে গোলমরিচ গুঁড়ো সংযোগে শরবত পানে প্রাথমিক পর্যায়ের জন্ডিসও সারে। এ ছাড়া ইউনানি ও আয়ুর্বেদিক বিভিন্ন ওষুধের উপকরণ হিসেবে বেল প্রচুর ব্যবহূত হয়।

বেলের বয়ান বিধৃত করতে গিয়ে যদি ন্যাড়ার কথা উল্লেখ না করা হয় তবে তা নির্ঘাত অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। ন্যাড়া ক’বার বেলতলায় যায়? যায় কি আদৌ? কেন এ কথার চল হয়েছিল তাই বা কে জানে! বাংলা বাগবিধিতে বেল নিয়ে আরও একটি বহুল প্রচলিত উক্তি হলো, ‘বেল পাকলে কাকের কী’? মধ্যযুগের কাব্য শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে আছে, ‘দেখিল পাকিল বেল গাছের উপরে/ আরতিল কাক তাকে ভখিতেঁ না পারে।’ কাকের অবশ্য আবর্জনা-উচ্ছিষ্টে যেমন রুচি, ফলফলাদি তার তেমন রুচে না। তবুও মাঝেমধ্যে সুযোগ-সুবিধা পেলে অন্যান্য ফলে সে ঠোকর দিয়ে থাকে বটে কিন্তু শক্তপোক্ত খোলসের কারণে বেলে তার চঞ্চুস্ফুটন অসাধ্য। শুধু কাকপক্ষীই নয়, ওই খোলসের জন্য অকালে ফল পাকানোর কলিকালের কায়দা-কৌশল থেকেও বেল সুরক্ষিত। রাসায়নিক তাকে দূষিত করে তোলেনি এখনো। বেল তার শ্রী নিয়েই আছে অকৃত্রিম। তাই এর আরেক নাম শ্রীফল।

আশীষ-উর-রহমান | প্রথম আলো
বেল বেল Reviewed by রেজওয়ান on 7:32 AM Rating: 5

No comments:

Powered by Blogger.