লবঙ্গ


লবঙ্গ, আমাদের কাছে মসলা হিসেবে সুপরিচিত। তবে ইতিহাস ও ভেষজ হিসেবে এর ব্যবহার অতি সুবিদিত নয়। অতি প্রাচীনকাল থেকেই লবঙ্গের ব্যবহার প্রচলিত ছিল। প্রাচীন মিসরে মমি তৈরির সময় যেসব জীবাণুনাশক উপাদান ব্যবহার করা হতো, তার মধ্যে একটি উপকরণ ছিল লবঙ্গের গুঁড়ো। প্রাচীন ভারতে চরক সংহিতায় লবঙ্গের ভেষজ গুণাবলির ভূয়সী প্রশংসা দেখতে পাওয়া যায়। মধ্যযুগের রাজনিঘন্টুতে আছে ‘লবঙ্গ সোষ্ণকং মধুরং হিমম’ মানে তীক্ষ, বিপাকে মধুর রস। লবঙ্গের বেশ কটি সমলংকৃত নাম আছে। যেমন দিব্য, শেখর, দেবকুসুম, ভৃঙ্গার, বারিসম্বর। এর আদি বাসস্থান মালাক্কা দ্বীপপুঞ্জ ও সেলিবিস দ্বীপ। এখন সুমাত্রা, মরিশাস, বোর্নিও দ্বীপপুঞ্জে চাষ হচ্ছে। দক্ষিণ ভারতের ত্রিবাঙ্কুরেও ব্যাপকভাবে এর চাষ হয়ে থাকে।
ইউরোপে মসলা হিসেবে লবঙ্গের ব্যবহার সুবিদিত ছিল। মার্কোপলো লবঙ্গের সুখ্যাতি ও সেই সঙ্গে এটি ইউরোপে প্রবর্তন করেছিলেন তেরো শতকে। তাই ইউরোপে লবঙ্গের ব্যবসা অত্যন্ত লাভজনক হয়ে পড়ে। পর্তুগিজ, ওলন্দাজ ও ফরাসিদের মধ্যে লবঙ্গের ব্যবসা নিয়ে ভীষণ প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখা যায়। ফলে ষোল ও সতের শতকে বেশ কয়েকটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল তাদের মধ্যে এই ব্যবসার কর্তৃত্ব নিয়ে।
এবার লবঙ্গগাছের কথা বলা যাক। ৩০ থেকে ৪০ ফুট উঁচু হতে পারে। চিরসবুজ, বহুসংখ্যক নরম ও অবনত শাখা চারদিক ছড়িয়ে পড়ে। ছাল ধূসর বর্ণ ও মসৃণ। পাতা সরল ও বিপরীত। উপবৃত্তাকার, পাঁচ ইঞ্চির মতো লম্বা। কচি পাতা লালচে। পুষ্পবিন্যাস ডালের আগার দিকে দেখা যায়, পার্শ্ববর্তী এক একটি ডালে তিন থেকে চারটি ফুল দেখা যায়। পাপড়ি চারটি, সাদাটে। অনেক পুংকেশর। গর্ভাশয় বহির্বাসের ভেতরে।
ফল মাংসল, প্রায় এক ইঞ্চি লম্বা। মার্চ থেকে জুন মাসে ফুল ও ফল হয়ে থাকে। পাকার আগেই বৃতিসহ ফুলের কুঁড়ি সংগ্রহ করা হয়। আর তা রোদে শুকিয়ে আমাদের পরিচিত লবঙ্গ তৈরি হয় (বাণিজ্যিক নাম ক্যালিস)। চীনের ভেষজ তালিকায় লবঙ্গ সুগন্ধি দ্রব্য হিসেবে পরিচিত। চীনা খাবারে লবঙ্গের ব্যবহার হয় না। তবে ভেষজ হিসেবে, দাঁতের ব্যথা ও পেটের অসুখে এর ব্যবহার প্রচলিত। আর ভারতীয় ভেষজে লবঙ্গের অনেক ব্যবহার দেখা যায়। প্রধান গুণাগুণের তালিকা এই রকম: উত্তেজক, সুগন্ধি, অগ্নিমন্দা ও পেটের বায়ুতে উপকারী। আর আছে জীবাণুনাশক শক্তি। লবঙ্গের প্রধান রাসায়নিক উপাদানগুলো হলো ইউজেনল, ক্যারিওফাইলিন। লবঙ্গ প্রজাতির বৈজ্ঞানিক নাম Syzygium aromaticum। আগের নাম ছিল Eugenia caryophyllus। পরিবার Myrtaceae। এটি ইংরেজীতে Clove নামে পরিচিত। এর ঘনিষ্ঠ প্রজাতি হচ্ছে কালোজাম ও গোলাপজাম। আমাদের দেশের স্যাঁতসেঁতে ও গরম আবহাওয়া লবঙ্গগাছের বৃদ্ধির অনুকূলে নয়।

লবঙ্গ (Syzygium aromaticum, অন্য নাম Eugenia aromaticum or Eugenia caryophyllata) এক প্রকারের মসলা। লবঙ্গ গাছের ফুলের কুড়িকে শুকিয়ে লবঙ্গ মসলাটি তৈরী করা হয়। খাদ্যদ্রব্যে মসলা হিসাবে এটি ব্যবহার করা হয়। লবঙ্গের আদি বাস ইন্দোনেশিয়ায়, তবে বর্তমানে এটি পৃথিবীর সর্বত্র ব্যবহৃত হয়। জাঞ্জিবার, ইন্দোনেশিয়া ও মাদাগাস্কারে লবঙ্গ চাষ করা হয়। এছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলংকাতেও লবঙ্গের চাষ হয়ে থাকে।

FAO এর ২০০৫ এর উপাত্ত অনুসারে ইন্দোনেশিয়াতে পৃথিবীর ৮০% লবঙ্গ উতপাদিত হয়। দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে রয়েছে যথাক্রমে মাদাগাস্কার ও তাঞ্জানিয়া।

লবঙ্গকে আস্ত অথবা গুড়া অবস্থায় রান্নায় ব্যবহার করা হয়। এর গন্ধ কড়া বলে অল্প পরিমাণে দিলেই চলে। ইউরোপ ও এশিয়া মহাদেশের প্রায় সব দেশেই এর ব্যবহার বিদ্যমান। ইন্দোনেশিয়াতে ক্রেটেক নামের সিগারেটে সুগন্ধি হিসাবে লবঙ্গ ব্যবহার করা হয়। চীনা ও জাপানীরা ধুপ হিসাবে লবঙ্গ ব্যবহার করে থাকে।
ভারতীয় উপমহাদেশের খাদ্যে দীর্ঘকাল ধরে লবঙ্গ ব্যবহার করা হয়ে আসছে। মেক্সিকোর খাদ্যেও এর ব্যবহার রয়েছে। এসব এলাকায় জিরা ও দারুচিনির সাথে লবঙ্গকে ব্যবহার করা হয়।


লবঙ্গের সুগন্ধের মূল কারণ "ইউজেনল" (Eugenol) নামের যৌগ। এটি লবঙ্গ থেকে প্রাপ্ত তেলের মূল উপাদান, এবং এই তেলের প্রায় ৭২-৯০% অংশ জুড়ে ইউজেনল বিদ্যমান। এই যৌগটির জীবাণুনাশক এবং বেদনানাশক গুণ রয়েছে। লবঙ্গের তেলের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো অ্যাসিটাইল ইউজেনল, বেটা-ক্যারোফাইলিন, ভ্যানিলিন, ক্র্যাটেগলিক অ্যাসিড, ট্যানিন, গ্যালোট্যানিক অ্যাসিড, মিথাইল স্যালিসাইলেট, ফ্ল্যাভানয়েড, ইউজেনিন, র‌্যাম্নেটিন, ইউজেনটিন, ট্রি-টেরপেনয়েড, ক্লিনোলিক অ্যাসিড, স্টিগ্মাস্টেরল, সেস্কুইটার্পিন।


লবঙ্গ লবঙ্গ Reviewed by রেজওয়ান on 12:45 PM Rating: 5

No comments:

Powered by Blogger.